স্টাফ রিপোর্টারঃদূর অতীতে শীতলক্ষ্যা নদীকে উবজীব্য করেই নারায়ণগঞ্জ বন্দরের পত্তন হয়েছে। যা পরবর্তিতে শিল্প ও বাণিজ্যসমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জ নগরীতে রূপান্তরিত হয়। স্বচ্ছ পানি, শান্ত স্বভাব ও দু’পারে প্রাকৃতিক খাড়ি সমৃদ্ধিই ছিল শত কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীতীরে নগরী পত্তনের কারণ।
বর্তমানে এ নদীটি ঊজান থেকে শুকিয়ে আসছে। একই সঙ্গে দূষণ,আবর্জনা আর দখলের কবলে পড়ে শুকনো মওসুমে এ নদী আর নদী পদবাচ্য থাকে না। শীতলক্ষ্যা এখন এক মুমূর্ষু নদী। আদি ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে সৃষ্ট এই স্রোতস্বিনী তার পূর্ব রূপ হারিয়ে ফেলেছে। নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা।
এসকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করে নিষ্কাশনের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীর অতি লোভ ও সরকারী নজরদারির অভাবে তা পালিত হচ্ছে না। সূত্র মতে, এ জেলায় ৩০০ টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি রয়েছে ( পরিবশে অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে)। কিন্তু ইটিপি থাকার পরেও নেই ইটিপির ব্যবহার। ফলে কারখানার বর্জ্য নালা খাল হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের গৃহস্থালি বর্জ্যও প্রতিদিন এ নদীতে মিশছে।
সরজমিনে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যার পানি দূষিত হয়ে কালো রং ধারন করেছে এবং পানিতে রয়েছে উৎকট গন্ধ। বর্ষায় প্রবাহ বেড়ে নদীর পানি কিছুটা পরিস্কার হলেও শুকনো মওসুমে এ নদীর পানি আর ব্যবহার যোগ্য থাকে না।
বর্তমানে এ নদী তীরে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে দূষণের ভয়াবহ চিত্র। বিশাল বিশাল ড্রেন ও ক্যানেলের মাধ্যমে শিল্প- কারখানা, ডাইং ফ্যাক্টরীর রঙিন পানি নদীতে পড়ছে। আশেপাশের এলাকার মানুষের ফেলা বর্জ্যে ক্রমেই দূষিত হচ্ছে নদী। লক্ষ্যা এখন একদিকে দূষণ ও অন্যদিকে দখলের কবলে। নদীর দুইপাশ সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ও ডকইয়ার্ড সহ বিভিন্ন স্থাপনার দখলে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
তীরবাসিদের অভিযোগ, শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য নদী দূষণের প্রধান কারণ। নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, সেখানে জলজ প্রাণের অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে। তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াদ বলেন, শীতলক্ষ্যায় একসময় শুনেছি জেলেরা প্রচুর মাছ ধরত। কিন্তু এখন সে চিত্র নেই। পানি যেভাবে দূষিত হচ্ছে মাছ বাঁচবে কিভাবে? নদীর পাড়ে শীতল বাতাসের জন্য মানুষ ঘুরতে আসে। কিন্তু দূর্গন্ধের কারণে সেখানে টেকা দায়।
বন্দরের বাসিন্দা শফিউল আলম একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে তাকে প্রতিদিনই নদী পারাপার হতে হয়। তিনি বলেন, শীতলক্ষ্যার পানি একসময় সচ্ছতার জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর অবস্থা এখন পুরাই বিপরীত। পানি কালো আর অনেক গন্ধ পানিতে। নদী পার হওয়ার সময় এখন নাকে কাপড় দিতে হয়। তার এ কথায় নৌকার মাঝি বলে উঠেন, এই পানি এক সময় খাইতাম আমরা আর এখন এই পানিতে গোসলও করা যায় না।
তবে ৫নং ঘাটের ফেরির পল্টুনে বসে অনেককেই নদীর পানিতে গোসল করতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে গোসল সেরে উঠে আসেন মো. আজম। ময়লা পানিতে গোসল করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, পানিতে ময়লা গন্ধ সবই জানি কিন্তু কি করমু , ঠেকায় পড়েই এই পানিতে গোসল করি। দূষিত পানির কারণে রোগ-বালাই হয় কিনা এই প্রসঙ্গে বলেন, হয় মাঝে মইধ্যে চুলকানি (অ্যালার্জি)।
পরিবেশ আন্দোলন ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক মনে করেন শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জের প্রাণ। কিন্তু বর্জ্য ও দখলের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা। নদী রক্ষার আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শীতলক্ষ্যা এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। নদীর দ’পার দখল করে নদীকে লম্বা খাল বানিয়ে দিচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেই মনে করে শীতলক্ষ্যার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী শিল্প বর্জ্য। নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. মইনুল হক বলন, শীতলক্ষ্যা শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও ক্যামিকেলের পানিতে দূষণ হচ্ছে। সকল শিল্প-কারখানায় ইটিপি নেই।
যেসকল প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তার অধিকাংশই ব্যবহার করে না। এসকল প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য আমাদের জনবল খুব কম। এছাড়াও মোবাইল কোর্টের জন্য আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট নেই। ঢাকা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আসলে তখন ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান পরিচালনা হয়। আর নদী রক্ষায় বিভিন্ন অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলে, নদী দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। তারা যখন ভ্রাম্যমান আদালত করতে চায় সকল ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এছাড়াও নদীর পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। একইসাথে জেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা হয়।