বেড়েছে আর্সেনিকের ঝুঁকি

620

স্টাফ রিপোর্টারঃ আর্সেনিক এক ধরনের বিষ। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা বিভাগে সর্ব প্রথম ১৯৯৮ সালে আর্সেনিক ধরা পড়ে। গত ২১ বছরে ঢাকা বিভাগে ৫ হাজারেরও বেশি রোগী সনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলাতেই ২ হাজার রোগী।

জেলার তিন উপজেলায় গত ২১ বছরে কমপক্ষে ৩০ জন আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। উপজেলা তিনটি হল আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ। দেশে উৎপাদিত চালে আর্সেনিকের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের দে মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় গবেষণা চালিয়ে এ প্রমাণ পেয়েছে।

বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘গ¬স ওয়ান’-এ তাদের এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আর্সেনিক আক্রান্ত ওই এলাকায় ১৮ হাজার ৪৭০ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপর গবেষণা চলে। তাতে দেখা যায়, যারা বেশি ভাত খান তাদের মূত্রে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে।

অন্যদিকে যারা কম ভাত খান তাদের ক্ষেত্রে এই বিষের মাত্রা কম। গবেষক দলের সদস্য, দে মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রাণচিকিৎসা বিভাগের বিশেষজ্ঞ পারভেজ হ্যারিস এর মতে, এই বিষে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা যাতে ভয়াবহ আকার ধারণ না করে সে জন্য ভাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। মূলত বিভিন্নভাবে আর্সেনিক গিয়ে জমছে জমিতে।

সেখান থেকে প্রবেশ করছে ধান গাছে। এরপর ধান থেকে চালে। পানি তোলার সময়ে মাটির গভীরে থাকা আর্সেনিকও সে সময় উপরে উঠে আসে। এভাবেই মাটির ওপরে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ে এবং তা পর্যায়ক্রমে গাছ, ফসল এবং মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে আর্সেনিক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জানাগেছে, ১৯৯৮ সালে জেলার আড়াইহাজার ও সোনারগাঁও উপজেলায় প্রথম আর্সেনিকের দেখা মিললেও দীর্ঘ ২১ বছরে তা প্রতিরোধে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও ২টি এনজিও আর্সেনিক আধিক্য এলাকায় শুধুমাত্র জরিপ কাজ করেই ক্ষান্ত রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগ স্থানীয় অফিসের মাধ্যমে ৩ উপজেলার ২৯৭টি নলকূপ ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে ২৭টিকে আর্সেনিকযুক্ত বলে শনাক্ত করে।

ফিল্ড কিটের মাধ্যমে আরো ১৬ হাজার নলকূপে পরীক্ষা চালিয়ে ১ হাজার ৪৯৫টি নলকূপকে আর্সেনিকযুক্ত বলে সনাক্ত করে লাল চিহ্ন দিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আর্সেনিকের ভয়াবহ ছোবল থেকে এ ৩ উপজেলার মানুষকে বাঁচাতে চিকিৎসা এমনকি সচেতনতার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এক হিসেব থেকে জানাগেছে, প্রথম দিকে জেলার সোনারগাঁ উপজেলায় ৩২০, আড়াইহাজার উপজেলায় ১৫০ এবং রূপগঞ্জ উপজেলায় ৩০ জনকে আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়। তবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলে জানালেন এনজিও সংস্থা রাসোসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

আড়াইহাজার উপজেলার ২হাজার পরিবার আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে। দুই দশক আগে উপজেলার বেশ কিছু নলকূপের পানিতে আশঙ্কাজনক মাত্রার আর্সেনিক ধরা পড়ে। উপজেলায় বেড়ে চলেছে আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।

বেসরকারি সংস্থা শিকাগো ইউনিভার্সিটি-আর্সেনিক অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের আড়াইহাজার শাখা সূত্রে জানাগেছে, সংস্থাটির অধীনে সর্বশেষ ২০০৮ সালে ১৯ হাজার টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করা হয়। এতে পানিতে শতকরা ৫১ ভাগ আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৫ হাজার ব্যক্তিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৭৬৫ জন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

এদের মধ্যে ৩০৯ জন নারী রোগী রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রতি লিটার পানিতে ০.০৫ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি আর্সেনিক থাকলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার জানান, আর্সেনিক মানবদেহে পচন রোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, হাত-পায়ের তালুতে ও বুকে-পিঠে চর্মরোগের সৃষ্টি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, উপজেলায় আর্সেনিক বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।

এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য ওষুধ সেবনের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকমুক্ত পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ও গভীর নলকূপ স্থাপন জরুরি। আর্সেনিক আক্রান্তদের জন্য সরকারি ওষুধ বরাদ্দ বর্তমানে নেই বলে তিনি জানান।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলার যে কোনো স্থানে ৪০০ থেকে ৭০০ ফুট গভীরে আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া যাবে। আর এই গভীর নলকূপ বসানোর ব্যয়ভার বহন করা গ্রামবাসীর পক্ষে সম্ভব না হওয়া সরকার পর্যায়ক্রমে অসচ্ছল পরিবারে নলকূপ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পানিতে কি পরিমাণ আর্সেনিক আছে এবং একজন ব্যক্তি কতদিন ধরে এই পানি পান করছেন- তার ওপর মৃত্যুঝুঁকি নির্ভর করে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া মৃত্যুর প্রধান কারণ না হলেও তা মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিনের মোট আর্সেনিক গ্রহণ ও প্রস্রাবে আর্সেনিকের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। পানিতে আর্সেনিক বেশি থাকলে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পান করলে ক্রনিক ডিজিজ, যথা ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি ৬৪% বেড়ে যায়। সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে প্রায় সমপরিমাণে। গবেষকদের মতে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান না করলে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।