‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’ লিয়াকতও ছিলেন বেপরোয়া

424

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জমি দখল, ডাকাতের মতোই লুটপাট; মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি-নির্যাতন; ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়; প্রথমে আতঙ্ক তৈরি করে পরে ইয়াবা কারবারি ও জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত; ছোট ইয়াবা কারবারিদের নির্মূল করে বড় কারবারিদের রেহাইয়ের সুযোগ করে দেওয়াসহ বহু অভিযোগ কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সদ্য কারাগারে যাওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি হয়েছিলেন সাময়িক বরখাস্ত। তাঁকে প্রত্যাহার ও বদলিও করা হয়েছিল। এর পরও অদৃশ্য ইশারায় পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ থানায় ওসির দায়িত্ব। ধামাচাপা দিয়ে গেছেন অভিযোগের পাহাড়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত এবং এক শীর্ষস্থানীয় নেতার কর্মী হিসেবে পরিচিত প্রদীপ ভোল পাল্টে প্রভাবশালী ওসি হয়েছেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা রাশেদ হত্যায় অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখে পড়তে পারেন টের পেয়েই অসুস্থতার ভান করে চট্টগ্রামের পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এর আগে ২০১৫ সালে মিথ্যা মামলায় ব্যবসায়ীকে ফাঁসানোর ঘটনায় ধরা পড়ে একইভাবে হাসপাতালে ভর্তি থেকে তদবির করেন প্রদীপ। তখন সাময়িক বরখাস্ত হলেও পরে ফিরে আসেন বীরদর্পে। কর্মজীবনে দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে হয়েছেন বহু কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সিনহা রাশেদ খুনে অভিযুক্ত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে।

এদিকে প্রদীপের নির্দেশে সিনহাকে গুলি করা পরিদর্শক লিয়াকত আলী ছিলেন বাহারছড়া এলাকার আতঙ্ক। মেরিন ড্রাইভ এলাকায় ওসির নির্দেশে নির্যাতন এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধ করে আলোচিত হয়েছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধেও ভয় দেখিয়ে অবৈধ সুবিধা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, আত্মীয়-স্বজনের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে জমি কিনে বাড়ি করেছেন প্রদীপ। রয়েছে গাড়ি। তাঁর স্ত্রী চুমকীর নামে চট্টগ্রাম মহানগরে ছয়তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে তাঁদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম কার্যালয়। একাধিক সূত্র দাবি করেছে, ভারতের আসামের রাজধানী গুয়াহাটি শহরের পল্টন স্টেশনের পাশে প্রদীপের দুটি অভিজাত বাড়ি রয়েছে।

১৯৯৫ সালে জোট সরকারের আমলে কক্সবাজারের শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কর্মী বলে পরিচিত প্রদীপ পুলিশে উপপরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন বনে যান প্রদীপ। ২০১৮ সালের মহেশখালী থানার ওসি থাকা অবস্থায় নিজেকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শী প্রমাণে উপজেলা কমিটির সভায় নিয়মিত হাজির হতেন প্রদীপ। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ছিলেন বিব্রত। তবে ক্ষমতাধর প্রদীপের ভয়ে কেউ আপত্তি জানাতে সাহস পাননি।

টেকনাফে হয়ে ওঠেন আতঙ্কের নাম : পুলিশে অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের তথ্যে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর প্রদীপকে মহেশখালী থানা থেকে টেকনাফের ওসি হিসেবে বদলি করা হয়। বিভিন্ন অভিযোগে আগেই প্রত্যাহার-বরখাস্ত হওয়া প্রদীপের মতো বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে রোহিঙ্গা, মাদক, মানবপাচারসহ জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইস্যুর কারণে গুরুত্বপূর্ণ থানায় দায়িত্বভার দেওয়ায় তখনও ব্যাপক সমালোচনা হয়।

টেকনাফে যোগদানের পর ইয়াবা কারবারিদের নির্মূল করা হবে ঘোষণা দেন ওসি প্রদীপ। শুরু হয় ক্রসফায়ারে মৃত্যু। তাঁর আমলে নিহত ১৬১ জনের মধ্যে কয়েকজন মাত্র শীর্ষ ইয়াবা কারবারি। তাঁর মধ্যস্থতায় শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের কয়েকজন আত্মসমর্পণ করেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, ইয়াবা সম্রাটদের দমন করার নামে ওসি প্রদীপ লোকজনকে টর্চারে মেতে ওঠেন।

টেকনাফের সমালোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ভাই মৌলভি মজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার তাঁর শেল্টারে প্রকাশ্যেই এলাকায় ঘুরছেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে বদির ভাগ্নে নিপু, খালাতো ভাই মংমং সেন, ভাই শফিকসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ তালিকাভুক্ত গডফাদার প্রকাশ্যে এলাকায় ফেরেন। এর দুই মাস পর ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা আত্মসমর্পণ করেন। বড় ইয়াবা কারবারিদের ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আখের গুছিয়ে পালিয়ে যেতে এবং আত্মসমর্পণ করতে সহায়তা করেন প্রদীপ।

গত দেড় বছরে পলাতক দেড় শ ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভেঙে দেয় পুলিশ। ক্রসফায়ার ও বাড়িতে হামলার কারণে অনেক গডফাদার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করে সমঝোতা করেন। যাঁরা সমঝোতা করেননি তাঁদের সহযোগীদের ধরে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে। এই সমঝোতার মাধ্যমে প্রদীপ শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

মহেশখালীতেও অপকর্মের রেকর্ড : ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি মহেশখালী থানার ওসি থাকাকালে ইয়াবা কারবারি ও জলদুস্যদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করাসহ অনেক অভিযোগ ওঠে প্রদীপের বিরুদ্ধে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে হেতালিয়া প্রজেক্টের লবণ চাষি আব্দুস সাত্তারকে ধরে পাহাড়ে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ওঠে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সন্ত্রাসী ফেরদৌস বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে তাঁকে প্রত্যাহারের দাবিতে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়।

মহেশখালী থানা এলাকার এক নারী ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন ওই থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়, টাকা না পেয়ে ওসি প্রায় ১০ লাখ টাকার লবণ লুট করে নিয়ে গেছেন।

চট্টগ্রামে অভিযোগের পাহাড় : চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় অপকর্মের কারণে সব সময়ই আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন প্রদীপ। বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি থাকাকালে ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট একটি বৈধ তেলবাহী লরি আটকে সিআইপি পদমর্যাদার একজন শিল্পপতিকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন তিনি। সুপার রিফাইনারি লিমিটেড নামে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদ পুলিশ প্রধানের কাছে হয়রানির অভিযোগ করেন। ‘তেলকাণ্ড’ শিরোনামে স্থানীয় সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশের পর শাস্তির বিষয়টি টের পেয়ে আগেভাগে পুলিশ হাসপাতালে নিজেকে ভর্তি দেখান প্রদীপ। সেখানে থেকে শাস্তি ঠেকাতে তদবির শুরু করেন তিনি। রক্ষা হয়নি। তদন্ত কমিটির সুপারিশে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে তখন সিলেট রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, পতেঙ্গা থানার ওসি থাকাকালে একইভাবে আরেকটি মামলা করেন প্রদীপ, যা পরবর্তী সময়ে হয়রানিমূলক বলে প্রমাণিত হয়। ২০১২ সালে আদালতের অনুমতি ছাড়া বন্দরে আসা একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা, বার্জ আটক এবং ১৮ দিন পর বার্জ মালিকসহ ১২ জনের নামে মামলা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর ও তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রমাণ মিললে ওসি প্রদীপকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর তাঁকে পাঁচলাইশ থানার ওসি করা হলে সেখানেও ব্যবসায়ীদের হয়রানির অভিযোগ ওঠে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় এসআই থাকাকালে নগরীর পাথরঘাটার এক হিন্দু বিধবা নারীর জমি দখল করেন প্রদীপ। পরবর্তী সময়ে পাঁচলাইশ থানা এলাকায় নিজের বোনের জমি দখল করেন তিনি। এসব অভিযোগ তদন্ত হলেও অদৃশ্য কোনো ইশারায় প্রদীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল চলাকালে পাঁচলাইশে শিবিরকর্মীদের পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার ছবি প্রকাশ পেলে বেশ আলোচনায় উঠে আসেন ওসি প্রদীপ। ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি একটি মামলার রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করায় লালদীঘিরপাড় থেকে এক আইনজীবীকে ধরে নিয়ে রাতভর থানায় আটকে নির্যাতন করেন ওসি প্রদীপ। ২৯ জানুয়ারি ওই আইনজীবী ওসিসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভায় ওসি প্রদীপের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনজীবীকে নির্যাতনের মামলাটি ধামাচাপা দিতেই শিবিরকর্মীদের গুলি করে আলোচনায় আসেন ধুর্ত প্রদীপ। ওই বছরের ২৪ মে ৪০ শিক্ষার্থীকে আটক করে শিবির আখ্যা দিলে পাঁচলাইশের ছাত্রলীগ-যুবলীগের তোপের মুখে পড়েন ওসি প্রদীপ। বাদুরতলা এলাকায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাস্তায় পিটিয়ে জখম করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ওসি প্রদীপ। এসব অভিযোগের পর ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট তাঁকে পাঁচলাইশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

রোষানলে পড়ে বিপর্যয়ে সাংবাদিক ফরিদুল : দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ প্রকাশের জেরে ‘কক্সবাজার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফাকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের বিরুদ্ধে। প্রদীপের রোষানলে পড়ে ২৩ মাস কারাগারে থাকলেও ক্রসফায়ারের ভয়ে তাঁকে জামিনে বের করছে না পরিবার।

লিয়াকত ছিলেন বেপরোয়া : স্থানীয় ও পুলিশের সূত্র মতে, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ২০১৪ সালে ছিলেন চট্টগ্রামে মহানগরের গোয়েন্দা বিভাগে। তাঁর দেওয়া মিথ্যা মামলায় এক ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় আট মাস আগে টেকনাফে যোগদানের পরই ওসির নির্দেশে মেরিন ড্রাইভে ক্রসফায়ারের দায়িত্ব নেন। বাহারছড়া কেন্দ্রে নিয়ে খুচরা মাদক কারবারিদের সহযোগীদের আটকে নির্যাতন করতেন তিনি। এভাবে টাকা আদায়ের মাধ্যমে সমঝোতা হতো। তা না হলেই ক্রসফায়ার হতো বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। সূএ কালের কন্ঠ