ক্রাইম রিপোর্টারঃ ঢাকায় বিপ্লবের ৫০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ রয়েছে। আর ঢাকার বাইরে রয়েছে শতকোটি টাকার সম্পদ বলছেন বিপ্লবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ফটিকছড়ি উপজেলার মানুষও কম অবাক নয় বিপ্লবকে নিয়ে। উপজেলা চেয়ারম্যান হোসাইন মুহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, ‘কয় দিন আগেও এই ছেলে ছাত্রদল করত, সাইকেল দিয়েও চলাফেরা করতে পারত না, এখন দামি দামি গাড়িতে করে এলাকায় আসে আর টাকা ছিটায়। এভাবে অপকর্মের টাকা ছিটিয়ে আওয়ামীলীগের নেতা সাজতে চায়। এসব হাইব্রিড ও নব্য অনুপ্রবেশকারী আওয়ামীলীগকে নষ্ট করে দিচ্ছে।’
আরও জানা যায়, কয়েক বছর আগে এলাকায় চু’রি করে ধরা পড়ার পর বাড়ি ছাড়ে বিল্লাল। এলাকার মানুষ এখনো তাঁকে “চোর বিল্লাল” নামেই চিনে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার এই ব্যক্তি নাম বদলে এখন মেহেদী হাসান বিপ্লব হিসেবে পরিচিত, যে বাংলাদেশে জেএইচএম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক। ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অপকর্মের দায়ে ওই দেশে কালো তালিকাভুক্ত বলে জানা গেছে।
মেহেদী হাসান বিপ্লবের পরিচয়, তিনি জেএইচএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। দেশ থেকে টাকা পাচারসহ ওই প্রতিষ্ঠানের নানা জালিয়াতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সে ঘন ঘন ভারতে যায় বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ভারতে জালিয়াতির অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত জেএইচএমের কর্ণধার তিন ভাই জাহাঙ্গীর আলম, হুমায়ুন কবির ও মেহেদী হাসান দুবাই এবং অন্য দেশ থেকে পাথরসহ বিভিন্ন উপকরণ বাংলাদেশে এনে বিক্রি করার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কারবারে জড়িত রয়েছে।মেহেদী হাসান বিপ্লবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর বিনিময়ে বিপুল অঙ্কের টাকা পায় বিপ্লব। সেই টাকা দিয়ে ঢাকার একাধিক জায়গায় জমি ও ফ্ল্যাট কিনেছে চোরা বিপ্লব। এলাকায় জনপ্রিয়তা পেতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছে দেদারছে। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে এলাকায় যাচ্ছে। এসব বিষয় নজরে আসার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা বিভাগও নড়েচড়ে বসেছে।
ভারতের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, দেশটির শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে জেএমএইচের মালিক তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে। দামি জামাকাপড় কলকাতা থেকে চেন্নাই হয়ে দুবাই পাঠানোর নামে তাঁরা কম দামি কাপড়সহ বিভিন্ন জিনিস পাঠাতেন। বিভিন্ন পণ্যের যে দাম নথিতে দেখানো হয়েছে, আসল দাম ছিল তার চেয়ে ৫০ গুণ কম। এভাবেই তাঁরা ভারত থেকে দুবাইয়ে অর্থ পা’চার করে গেছে। আরও জানা গেছে, জামায়াতি মতাদর্শে বিশ্বাসী জেএইচএম গ্রুপ বিপ্লবের হাত ধরেই বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করেছে। ছাত্রদলের একসময়ের এই কর্মী টাকা ছিটিয়ে এলাকায় আওয়ামীলীগের নেতাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মেহেদী হাসান বিপ্লব ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নের বালুটিলা গ্রামের ফরিদ আহমেদের ছেলে। ফরিদ পেশায় ছিলেন দিনমজুর। বিপ্লবের পড়ালেখা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চুরির অপরা’ধে এলাকা ছাড়ার পর বিপ্লব সিলেটে চলে যায়। সেখানে এক পাথর ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর শ্বশুরের পাঁচ ট্রাক পাথর চু’রি করে সিলেট ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। এরপর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে বিয়ে করে ফেনীর এক মেয়েকে। সিলেটে পাথর ব্যবসার সুবাদে জেএইচএম গ্রুপের কর্ণধারদের সঙ্গে পরিচয় হয় বিপ্লবের। এরপর জা’লিয়াতির নতুন জীবন শুরু হয় তাঁর। ভারতে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশকে টার্গেট করে জেএইচএম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি এ দেশে ব্যবসা করে অর্থ পা’চার করে দুবাই ও ভারতে। ঢাকায় থেকে টাকা পাচারের কাজটি সমন্বয় করেন প্রতিষ্ঠানটির ডিএমডি বিপ্লব। জানা গেছে, বাংলাদেশে আটটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন মেহেদী হাসান বিপ্লব। এগুলো হলো জেএইচএম ইন্টারন্যাশনাল, জেএইচএম ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট, জেএইচএম লজিস্টিকস, জেএইচএম ওভারসিজ, জেএইচএম রাইসমিলস, জেএইচএম কনস্ট্রাকশন, ফিরোজা হেলথ কেয়ার সেন্টার ও জেএইচএম এলএলসি দুবাই।
ফটিকছড়ির বালুটিলা এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, ‘বিল্লালের এখন অনেক টাকা। একসময় সংসার চালানোর মতো অবস্থা ছিল না। এখন উপজেলার নানা জায়গায় নেতাদের এনে ত্রাণ দেয়, টাকা দেয়। একেক দিন একেকটা দামি গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসে।’
ঐ এলাকার আরেক বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ‘ইতার হোন হিসু ন আছিল (তার কোনো কিছু ছিল না)। অহন দামি গাড়িত গরি আইস্যা (এখন দামি গাড়িতে করে এসে) ফু’টা’নি মা’রে। কোটি কোটি ট্যায়া (টাকা) তার।’নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দাঁতমারা বাজারের এক বিএনপি নেতা বলেন, একসময় বিপ্লবের খরচ চালাতেন। তখন তাঁর থাকা-খাওয়ার টাকা ছিল না। সে এলাকায় ছাত্রদল করত।
দাঁতমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মো. জানে আলম বলেন, ‘পাহাড়ের ওপরে ছোট্ট একটা ঘরে থাকত বিপ্লব। আর এখন জায়গাজমি বহুত কিনেছে। টাকার গরমে মাটিতে পা পড়ে না।’
জানা গেছে, রাজধানীর ভাটারা থানার একটি অভিজাত এলাকায় তিনটি ফ্ল্যাট এবং ছয়টি প্লট রয়েছে বিপ্লবের। এর মধ্যে ১২ কাঠা জমির ওপর একটি সাততলা ভবন তৈরি করছে বিপ্লব। ভাটারা এলাকায় থাকা তাঁর ফ্ল্যাট ও জমির দাম প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। বনানীর ১১ নম্বর রোডের ৫০ নম্বর প্লটের চারতলা ভবনে তিন কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছে বিপ্লব। গুলশান-২-এর বিলকিস টাওয়ারে বিপ্লবের রয়েছে চার হাজার বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটের দাম ২০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে। ঐ ফ্ল্যাটেই অফিস করেছে বিপ্লব। এর বাইরে ২০টি ট্রাক এবং খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতকোটি টাকার জমি রয়েছে তাঁর। দুটি জাহাজ রয়েছে, যেগুলো নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিক। আছে একটি বিএমডাব্লিউ, একটি হ্যারিয়ার ও প্রাডো গাড়ি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান বিপ্লব বলে, ‘ফটিকছড়ি এলাকার সবাই ফরেস্টের বাড়িতে থাকে। আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি এলাকায়, এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। জেএইচএম গ্রুপ বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসেছে। আমি তাদের বাংলাদেশে এনেছি। ভারতে যে মামলা কোম্পানির বিরুদ্ধে রয়েছে, তা সমাধান করা হয়েছে জানুয়ারি মাসে। এলাকায় চুরির কোনো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে নেই। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না।’ চলবে ………