শুধু ক্যামেরা কিনেই দুর্নীতি ১০ কোটি টাকা

209

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ৫০ হাজার টাকার ক্যামেরা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা কিনে প্রকল্প পরিচালক ২০০ সরকারি কলেজে থেকে দুর্নীতি করল প্রায় ১০ কোটি টাকা।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত বছরের মার্চ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ২০০ সরকারি কলেজে কেনা হলো ডিজিটাল ক্যামেরা। সেই ক্যামেরার দাম ৫০ হাজার, ৬০ হাজার বা লক্ষাধিক টাকাও নয়, প্রতিটি ক্যামেরা কেনা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার টাকায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে উচ্চমূল্যে এই ক্যামেরা কেনায় এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক মো. নূরুল হুদাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালককে ওএসডি ও শোকজ করা হয়েছে। এখন আমরা জবাবের অপেক্ষা করছি। তবে এটা বলতে পারি, অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না।’

আরও জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে  সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প  হাতে নেওয়া হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে, যা শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের জুনে। এই প্রকল্পের অধীনে দেশের ২০০ সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ সম্প্রসারণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যমান আইটি সরঞ্জাম এবং আরো উন্নত মানের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্গম এলাকার কলেজে ৪৭টি হোস্টেল নির্মাণ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহসহ নানা কাজ করার কথা। শুরু থেকেই এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন মো. নূরুল হুদা। গত ২ মে নূরুল হুদাকে শোকজ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানাতে ১০ দিনের মধ্যে জবাব পাঠাতে বলা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত শোকজ তাঁর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক নূরুল হুদা ২০০টি সরকারি কলেজের জন্য ১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ই-জিপি সিস্টেম পোর্টালে দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ২ মার্চ র্যাংগস ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের সঙ্গে ক্যামেরা কেনার চুক্তি সম্পাদন করেন। ওই বছরের ২৯ জুন এসব মালপত্র গ্রহণের সর্বশেষ সময় ছিল। তবে সেই বছরের ১৫ জুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতির সভায় ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন—  ‘করোনার এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই এই সময়ে ক্যামেরার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বিধায় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় প্রক্রিয়াটি বাতিল করেন। সে সময় ওই প্রকল্পের পরিচালক মন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। ফলে সভার রেজল্যুশনেও ক্যামেরা কেনার বাতিলের সিদ্ধান্তটি লেখা হয়। মালপত্র গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিয়মানুযায়ী তা বাতিলের এখতিয়ারও রয়েছে প্রকল্প পরিচালকের।’

মন্ত্রণালয় আরো বলছে, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২০ সালের ২৯ জুনের মধ্যে মালপত্র গ্রহণের কথা থাকলেও ১৫ জুন প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউস থেকে মালপত্র গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে ই-মেইল দেওয়া হয়। তখন শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া বাতিল না করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব পাঠান প্রকল্প পরিচালক। তবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮-এর ৪২ বিধি অনুসারে জনস্বার্থে ওই সব ক্যামেরা কেনার ইজিপি প্রক্রিয়া বাতিল বা চুক্তি বাতিল করার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পরও প্রকল্প পরিচালক ক্যামেরা কেনার বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে ১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে তড়িঘড়ি করে ২০০টি ডিজিটাল ক্যামেরা কেনেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শুধু ক্যামেরা কেনা নয়, দাম নিয়েও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা প্রফেশনাল ক্যামেরা ব্যবহার করেন, সেগুলোর দামই থাকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে। এক লাখ টাকায় হাই রেজল্যুশনের ডিজিটাল ক্যামেরা পাওয়া যায়। সেখানে কলেজগুলোতে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার ক্যামেরাই যথেষ্ট ছিল। আর যেগুলো কেনা হয়েছে, সেগুলোর দামও কয়েক গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। এমনকি নতুন নির্মিত ভবনে এই ক্যামেরা রাখার কথা থাকলেও এখনো সেই ভবনের নির্মাণকাজই শেষ হয়নি। অথচ উচ্চমূল্যে ক্যামেরা কিনতে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে কেনাকাটার প্রক্রিয়া শেষ করেছেন পিডি।

সাবেক প্রকল্প পরিচালক মো. নূরুল হুদার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শুধু বলেন, ‘আমি যেহেতু আর প্রকল্প পরিচালক নই, তাই এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। যা বলার তা শোকজের জবাবেই বলব।