সোনারগাঁ প্রতিনিধিঃ নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁয়ের পল্টিবাজ রেজাউল করিম ও লিয়াকত আলী ক্ষমতার সুবিধার্থে রাজনৈতিক দলবদলই তাদের পেশা ও নেশা। কখনও বিএনপি, কখনও আওয়ামীলীগ আবার কখনোবা জাতীয় পার্টি,কখনোবা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপে। মূল দল হোক আর বিদ্রোহী হোক,ক্ষমতার পাল্লা যেদিকে ভারী সেদিকেই দেখা যাবে তাদেরকে দুজনকে।
বারবার রাজনৈতিক ডিগবাজি খেয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারাটাই তাদের মূল টার্গেট।জানা যায়, যোগদানের এক বছরের মাথায় দুই নেতা সম্প্রতি জাতীয় পার্টি ছেড়ে যাওয়ায় সোনারগাঁ এর স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্থানীয় সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকার নাম ভাঙ্গিয়ে সালিশ বিচারের নামে অর্থ আত্মসাৎ
ও জনসাধরণকে হয়রানি করাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠে জাপা নেতা রেজাউল ও লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে। এতে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরাও তাদের তোপের মুখে পড়ে কোনঠাসা হয়ে পড়া রেজাউল ও লিয়াকত সম্প্রতি (১৭ মে) জাতীয় পার্টি ছেড়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপে ভিড়েছেন।
সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার হাত ধরে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এদিকে রেজাউল ও লিয়াকতের দলত্যাগে স্থানীয় জাতীয় পার্টির শিবিরে স্বস্তি নেমে এসেছে। ডিগবাজিতে পটু এই দুই নেতা দল ছেড়ে যাওয়ায় তাদের অপকর্মের অপবাদ ও বদনাম থেকে রক্ষা পেয়েছে জাতীয় পার্টির ইমেজ। এতে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরাও খুশি বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে সোনারাগাঁ আওয়ামীলীগের মূল শিবিরে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এসব হাইব্রিড নেতার আগমন প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম ভুইয়া জানান,দলে বিএনপির লোকের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। তিনি জানান,সোনারগাঁ আওয়ামীলীগে কাউকে যোগদান করানো হয়নি, হবেও না। তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চেয়েছিল,কিন্তু বিতর্কিতদের আমরা না করে দিয়েছি।তবে দল থেকে বহিস্কৃত এক নেতার দলে নাকি তারা যোগ দিয়েছেন শুনেছি। তারা কখনও আওয়ামীলীগে জায়গা পাবে না, বরং আমাদের নেতাকর্মীরা তাদের মত বিতর্কিতদের প্রতিহত করবে।
তিনি বলেন,রেজাউল ও লিয়াকত দুজনই বিতর্কিত ও সুবিধাবাদী হাইব্রিড নেতা।এরা ক্ষমতার সাইন বোর্ড ব্যবহার করে,একসময় বিএনপি করতো। তারপর আওয়ামীলীগে ভিড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুযোগ না পেয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়, এখন সেখানে অপকর্ম করতে না পেরে ফায়দা লুটতে আওয়ামীলীগের বহিস্কৃত নেতার কাছে গিয়ে প্রচার করছে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। তিনি রেজাউল ও লিয়াকতের ব্যাপারে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই জানান,কে যোগদান করালো, কিছুই তো জানি না। এধরণের কর্মকাণ্ডে কিছু লোক আওয়ামীলীগের ক্ষতি করছে। বিতর্কিত কারও আওয়ামীলীগে জায়গা নেই। এত নেতাকর্মী আমরা আমাদের লোকজনকে জায়গা দিতে পারি না, সেখানে অন্যদলের বিতর্কিতদের আওয়ামী লীগে আনতে হবে কেন?
খবর নিয়ে জানা গেছে,নারায়ণগঞ্জ সোনারাগাঁ নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকার হাত ধরে স্থানীয় জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ও আধিপত্য বাড়লে ক্ষমতার মধুলোভী পৌর বিএনপির সহ সভাপতি রেজাউল করিম ও লিয়াকতরা স্থানীয় রাজনীতিতে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। মামলা মোকাদ্দমা থেকে রক্ষাসহ ক্ষমতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে ডিগবাজির পরিকল্পনা নেয় রেজাউল করিম ও লিয়াকত আলী। অবশেষে ২০২০ সালের ৫ মার্চ পৌর বিএনপির নেতা রেজাউল করিমের নেতৃত্বে লিয়াকত আলীসহ অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য স্থানীয় সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকার হাতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। যোগদানের অল্পদিনেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন রেজাউল ও লিয়াকত আলী। এমনকি এমপি খোকার নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন স্থানে সালিশ বিচারের নামে জনগণকে হয়রানির অভিযোগ আসতে থাকলে স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা দুজনের উপর ক্ষুব্ধ হন। দুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলীয় এমপিকে একাধিবার নালিশও দেন নেতাকর্মীরা। জনসাধারণের অভিযোগ ও নেতাকর্মীদের জোরালো দাবির মুখে বিতর্কিত রেজাউল ও লিয়াকতকে গত তিনমাস ধরে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষিদ্ধ করেন এমপি খোকা। স্থানীয় নেতাকর্মীরাও তাদের বর্জন করা শুরু করলে কোনঠাসা হয়ে পড়েন রেজাউল ও লিয়াকত। এরমধ্যেই জাতীয় পার্টিতে সুবিধা করতে না পেরে ক্ষমতার ফায়দা লুটতে তারা সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামীলীগে যোগদিতে যোগাযোগ শুরু করে দেন। কিন্তু উপজেলা আওয়ামীলীগ গ্রহণ না করলে তারা বহিস্কৃত আওয়ামী লীগ নেতার কাছে ভিড়ে যান।
জানা গেছে, পৌর বিএনপির সাবেক নেতা রেজাউল করিম ও লিয়াকত আলী তারা দুজনই একসঙ্গেই ডিগবাজির রাজনীতি করেন,মনে হয় যেন স্বামী স্ত্রী, যেখানে যান একসঙ্গে যান, দলবদলও করেন একসঙ্গে। রেজাউলের বাড়ি পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডে আর লিয়াকতের বাড়ি পৌরসভার ৬নম্বর ওয়ার্ডে। কিছুদিন আগে সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সের সামনে দুজনেই মিলে সোনারগাঁ মডার্ণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি ক্লিনিক গড়ে তুলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনারগাঁ পৌরসভা জাতীয় পার্টির এক নেতা জানান,এরা কিসের রাজনীতিক? দলবদল করা এদের পেশা,এরা দলের নামে দালালি করে।যেখানে মধু সেখানে দৌড়ায়। জাতীয় পার্টি থেকে চলে যাওয়ায় আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি।
জানা গেছে,১৯৯১-৯২ সালের দিকে চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেন রেজাউল করিম ও লিয়াকত আলী। রেজাউল করিম পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি হন। চারদলীয় জোট সরকারের পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিএনপি থেকে ডিগবাজি দেন রেজাউল ও লিয়াকত। তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সারের হাত ধরে নৌকায় ভিড়ে যান। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারা আওয়ামী.লীগের পদপদবি না পেলেও ক্ষমতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে চলেন। ২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের হয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি নির্বাচিত হন। এসময় তারা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এসময়ে তারা আওয়ামী লীগে পদ পদবি না পেয়ে অন্যদিকে জাপায় যোগ দিতে না পেরে পুরাণ দল বিএনপিতে সক্রিয় হন। ২০২০ সালে পৌরসভা বিএনপির পদ পদবি থেকে ডিগবাজি দিয়ে স্থানীয় সাংসদ এমপি খোকার হাত ধরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন তারা।
একবছর পার হতেই আবার তারা জাতীয় পার্টি ছেড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী গ্রুপে যোগ দেন তারা।
এ বিষয়ে জাপা ছেড়ে যাওয়া রেজাউল করিম বলেন,জাতীয় পার্টি আওয়ামীলীগের জোটের শরিকদল। আমরা মনে করি জাপার চাইতে সরাসরি আওয়ামীলীগ করাই ভালো।
তিনি বলেন, আওয়ামীলীগের একটি অনুষ্ঠানে আমরা গিয়েছিলাম, প্রাথমিক যোগদানের বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। আসলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস থেকেই আমরা আওয়ামীলীগকে ভালবাসি।
জাপায় এসে আপনারা বিতর্কিত কাজ করেছেন জাপা নেতাদের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, কে কি বলল জানি না, আমরা বিতর্কিত কোনও কাজ করি নাই।
অপর নেতা লিয়াকত আলীর সঙ্গে কথা বলতে ফোন করা হলে তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক সানাউল্লাহ সানু জানান, ব্যক্তিগত স্বার্থ
হাসিলের জন্য এসব আগাছা দলে এসে এক বছরে নানা অপকর্ম করে দলকে বিতর্কিত করে ফেলেছিল, তারা চলে যাওয়ায় আমি মনে করি জাতীয় পার্টি আগাছমুক্ত হয়েছে। বরং নারায়নগঞ্জ জেলা ও উপজেলা জাতীয় পার্টিতে এখন কোনও সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ঠেন্ডারবাজ নেই।