প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতারনায় ৫ জন গ্রেফতার

189

নরসিংদী প্রতিনিধিঃ  বিনিয়োগ অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওেয়া প্রতারনার অন্যতম হোতা ও প্রতিষ্ঠান চেয়ারম্যান শাহ আলমসহ ৫ জনকে নরসিংদী  থেকে গ্রেফতার করছে র‍্যাব-১১।

র‌্যাব প্রতিষ্ঠানলগ্ন থেকে বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। র‌্যাবের সৃষ্টিকাল থেকে অদ্যাবধি জঙ্গি, মাদক, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও প্রতারকচক্র গ্রেফতারে সদা তৎপর রয়েছে। এছাড়াও ২০২১ সালে ইভ্যালি, ধামাকা, এহসানগ্রপসহ বেশ কয়েকটি প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে সাধারণ জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে র‌্যাব।

সাম্প্রতিক সময়ে সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বর্ণিত প্রতারণার ঘটনা প্রচারে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট অভিযোগ দায়ের করে।

নরসিংদী জেলার প্রায় সকল থানার ৫-৬ হাজার সাধারণ পেশাজীবি মানুষ একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে ব্যবসায়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ প্রাপ্তির আশায় শত শত কোটি টাকা অর্থ বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রতারক চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষের প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। একদিকে করোনা মহামারিতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা অপরদিকে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে পথে বসেছে চক্রটির খপ্পরে পরা নরসিংদীর সর্বস্তরের শতশত মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী জণগন তাদের গচ্ছিত টাকা ফিরে পাবার আশায় স্থানীয় সমবায় অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করে। যার ফলশ্রæতিতে জেলা সমবায় অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু প্রতারকরা লাপাত্তা হয়ে যায়।

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় গুটিয়ে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নরসিংদী জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। যার পরিপেক্ষিতে স্থানীয় পত্র-পত্রিকাসহ জাতীয় প্রিন্ট ও ইকেট্রনিক মিডিয়ায় তা বহুলভাবে প্রচারিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার তৈরী হয়। বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চলতে থাকে। ঘটনাটি সারাদেশে প্রচারিত হলে নরসিংদীর সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃস্টি হয়। যার ফলশ্রæতিতে নরসিংদী জেলার পলাশ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ শেষে বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে নরসিংদীর পলাশ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পাশাপাশি ভ‚ক্তভোগীরা জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরেও অভিযোগ প্রদান করে। সংঘটিত ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইনি সহযোগিতার প্রত্যাশায় লিখিত অভিযোগ নরসিংদীতে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর কার্যলয়ে এসে জমা দেয়। ফলশ্রæতিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে গত রাতে নরসিংদী জেলার সদর থানাধীন ভেলানগর এলাকায় গোপন বৈঠক চলাকালীন সময়ে উক্ত প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা (১) মোঃ শাহ আলম (৫০), পিতাঃ মৃত হাসান আলী, গ্রাম-দক্ষিনচর ভাসানিয়া, থানা-মাধবদী, জেলাঃ নরসিংদী, এবং তার ০৪ সহযোগী (২) মোঃ দেলোয়ার হোসেন শিকদার(৫২), পিতা- মৃত জাফর আলী শিকদার, গ্রাম-ঘোড়াদিয়া, থানা-সদর, জেলা-নরসিংদী, (৩) কাজী মানে উল্লাহ(৪৪), পিতা-মৃত নূর চান কাজী, গ্রাম-বাখর নগর, থানা-সদর, জেলা-নরসিংদী, (৪) মোঃ সুমন মোল্লাহ(৩৩), পিতা- মৃত আঃ রশিদ মোল্লাহ, গ্রাম-ঘোড়াদিয়া সাকুরঘাট, থানা-সদর, জেলা-নরসিংদী এবং (৫) আঃ হান্নান মোল্লাহ (৩০), গ্রাম-মোঃ নুরচার মোল্লাহ, থানা-প্রারাতলা, জেলা-নরসিংদীদের’কে গ্রেফতার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ২০১০ সালে নরসিংদী জেলার সদর থানাধীন চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় একটি শরিয়াভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে একটি প্রতারক চক্র। প্রতারকচক্রটি অতি সুকৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদ মুক্ত ব্যবসায় প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের নিকট হতে আমানত সংগ্রহ করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে তাদের সংস্থার সদস্য করা হত। সুদমুক্ত জীবন যাপন ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের লোক দেখানো মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। উক্ত চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম নিজে কোম্পানীর চেয়ারম্যান হিসেবে ০৪টি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং ২৪ জন জনবলের সমন্বয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে ও অতিরিক্ত ২০ জন পরিচালক নিয়োগ দেয়। আত্মীয় বা পরিচিতদেরকে তারা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিত। পরবর্তীতে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন থানার জনবহুল ও ব্যবসায়ীক এলাকায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো; শাহ সুলতান এম.সি.এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ, স্বদেশ টেক্সটাইল লিঃ, শাহ সুলতান টেক্সটাইল লিঃ ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লিঃ।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেফতারকৃতদের প্রায় ৩ শতাধিক কর্মী রয়েছে। যাদেরকে কোন প্রকার বেতন প্রদান করা হয় না। তাদেরকে গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে এককালীন ১০% ও বছরান্তে ৬% অর্থ প্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হত। গ্রেফতারকৃতরা বিনিয়োগকারীদেরকে বার্ষিক ১২-১৬% মুনাফার প্রলোভন দেখাত। এছাড়াও তারা গ্রাহকদের নিকট হতে উচ্চ মুনাফায় মাসিকভিত্তিতে ডিপিএস এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত বলে জানায়। ফলশ্রæতিতে তারা গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন। তারা বেশকিছু গ্রাহককে উচ্চ মুনাফায় লোন প্রদান করে। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতই গ্রাহকদের নিকট হতে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করত। গ্রাহকদের সংগৃহীত অর্থ ল্যান্ড প্রজেক্ট টেক্সটাইল ও নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তারা এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে বলে জানায়। গ্রাহকদের তথ্যমতে সংগৃহীত টাকার পরিমান আরো বেশি  হতে পারে।

করোনার ক্রান্তিলগ্নে যখন মানুষের টাকার প্রয়োজন হয়; তখন ভুক্তভোগীরা তাদের আমানতকৃত টাকা শাহ সুলতান এম.সি.এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর নিকট উত্তলনের আবেদন করে। তখনই তারা করোনা মহামারীসহ বিভিন্ন অযুহাতে গচ্ছিত টাকা ফেরত না দিতে গড়িমসি শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ওমর ফারুক ও ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাসুদ রানা গ্রাহকদের লগ্নিকৃত টাকা দিয়ে নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে ৫-৬ একর জমি নিজেদের নামে ক্রয় করে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির নামে নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে ৭-৮ একর জমি রয়েছে বলে জানা যায়। টাকা ফেরতের জন্য গ্রাহকদের ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক ব্যবসায় খুব সহজেই উদ্ধুদ্ধ হয় বিধায়, সুদ বিহীন ব্যবসার প্রলোভন দ্রæত মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরী করে। শরিয়া ভিত্তিক ব্যবসাকে প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের কুটকৌশল খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে।

গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।