নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিঃ দেশের ভেতরে অবৈধ মজুতদারির পরও এবার সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হচ্ছে ভোজ্যতেল। কারণ দেশটিতে ভোজ্যতেলের দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। এর ফলে একশ্রেণির মুনাফালোভী জড়িয়ে পড়ছে এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
এর ফলে দেশের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ভোজ্যতেল নিয়ে বাজার অস্থিরতার যতগুলো কারণ রয়েছে এর মধ্যে এটিও অন্যতম।
এদিকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নিশ্চিত হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সূত্রমতে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শিগগির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভোজ্যতেল পাচারের ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর একটি চিঠি দিয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবিকে চিঠি দেওয়া হবে। যাতে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়।’
সূত্র জানায়, সীমান্ত দিয়ে ভোজ্যতেল পাচারের তথ্য জানিয়ে গত ১০ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলসহ আমদানিকৃত পণ্যের বাজার মূল্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বয় করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিত সরকার কর্তৃক ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কম। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও
মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ভোজ্যতেল পার্শ্ববর্তী দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভোজ্যতেল পার্শ্ববর্তী দেশে যেন পাচার না হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে পত্র পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।’
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশের ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারতের মূল্যকেও বিবেচনায় নিয়ে মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সেক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশের মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে সার, বীজ, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল পাচার প্রতিরোধে বাজার ব্যবস্থাপনা দিয়ে কাজ হবে না। সেক্ষেত্রে মূল্য ব্যবস্থাপনা দিয়ে ভোজ্যতেল পাচার প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থাৎ ভারতের ভোজ্যতেলের দামের তুলনায় যাতে বাংলাদেশে কম না হয়। এখানে কম থাকলে পাচার ঠেকানো যাবে না। তাই এভাবে করতে পারলে ভোজ্যতেলের পাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে এক কেজি সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ১৮৯.৫৯ এবং সর্বনিম্ন ১৬৪.২ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে কোম্পানিভেদে দেশি মুদ্রায় দাম পড়ে ১৮৪ থেকে ২১২ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ভারতে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১২৮.৫ রুপিতে, যা দেশীয় মুদ্রায় দাঁড়ায় ১৪৪ টাকা।
এদিকে মঙ্গলবার টিসিবির হিসাবে দেশের বাজারে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের ক্যান বিক্রি হয় ৮০০ টাকা। যার এক লিটারের মূল্য দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। এছাড়া প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হয় ১৫৫ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশের সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি মূল্য পার্থক্য সর্বোচ্চ ৫২ টাকা। এই বাড়তি টাকা মুনাফার লোভে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশে বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য কিছুটা কম থাকার কারণ হচ্ছে সরকার প্রতি লিটারের মূল্য বেঁধে দিয়েছে। এছাড়া বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টনের মূল্য ১ হাজার ৯শ মার্কিন ডলারে উঠেছে। কিন্তু দেশের ভেতর যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার আমদানি মূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ২শ মার্কিন ডলার। যে কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের স্থানীয় বাজারে ভোজ্যতেলের খুচরা মূল্যের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ভোজ্যতেলের পরিস্থিতি নজরদারি করতে নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া পুলিশ, র্যাব ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। রিফাইনারি, পাইকারি বাজার ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি করা হচ্ছে। যে কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে অবৈধ মজুত করা ভোজ্যতেল প্রায় প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে বলেন, ‘দাম বেশি হলে ভারতে পাচার হবেই। তবে এ ধরনের ঘটনা সত্যি হলে সরকারকে অবশ্য দ্রুত বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য গঠিত কমিটিগুলো যাতে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে। বিষয়টি যেন ফেলে রাখা না হয়।’ এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ‘আমদানি, রিফাইনারি ও পাইকারি পর্যায়ে শেষ রোজা পর্যন্ত মনিটরিং অব্যাহত রাখা, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা এবং ওএমএস চালু রাখার লক্ষ্যে সরকার নিজস্বভাবে ভোজ্যতেল আমদানির উদ্যোগ নিতে পারে। এতে বড় আমদানিকারক ও রিফাইনারিরা চাপের মুখে থাকবেন।’