নিজস্ব প্রতিনিধি :
সংসদ সদস্য, মন্ত্রী কিংবা জনপ্রতিনিধি নয়, তাঁকে বলতে হয় মাফিয়া সাম্রাজ্যের গডফাদার! রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন তিনি। জমি জবরদখল, বালু ব্যবসা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, কমিশন বানিজ্য, টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজি থেকে শুরু করে প্রতারণা-জালিয়াতিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত ৩৪ বছরে বিস্তর অর্থ-বিত্ত আর সম্পদে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে তাঁর। হাজারের বেশি বিঘা জমির মালিক তিনি। এছাড়াও একাধিক শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁর। একইসঙ্গে তিনি প্রথম শ্রেণির একজন ঠিকাদার। তাঁর মালিকানাধীন রয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এন. জেড গ্রুপ নামক একটি টেক্সটাইল কোম্পানি। পরিসংখ্যান ও অনুসন্ধান বলছে, অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। দেশে-বিদেশে অসংখ্য ব্যাংক এ্যাকাউন্ট আছে তাঁর। আর এ অবৈধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে গড়ে তোলেন বিশাল সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক। অর্থের প্রভাবে প্রশাসনকেও কিনে রেখেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, টর্চার ক্যাম্প, নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী আর অস্ত্র দিয়ে কায়েম করেন ভয় আর ত্রাসের রাজত্ব। নিজস্ব সিন্ডিকেট নিয়ে ভূমিদস্যুতাসহ একের পর এক অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য এক মাফিয়া সম্রাট। রূপগঞ্জের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দফতর, শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কৌশলে ফিটিং দিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতানোর তথ্য পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। একজন ঠান্ডা মাথার ভয়ঙ্কর খুনী তিনি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক তিনবারের বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান। মাফিয়া সাম্রাজ্যের এই গডফাদারের নাম নূরুজ্জামান খাঁন। তবে স্থানীয়দের কাছে নূরু খাঁ বা মধুবাবু নামে পরিচিতি তাঁর।
…..
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রামের জহিরুল ইসলাম খাঁনের ছেলে তিনি। একসময় ছিলেন রাজমিস্ত্রী, তবে সময়ের পালাক্রমে হয়ে ওঠেন ঠিকাদার, আর সেখান থেকেই তাঁর রাজনীতি শুরু। ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরীর হাত ধরেই রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ হয় তাঁর। এরপর জড়িয়ে পড়েন জমি ব্যবসায়। আস্তে-আস্তে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী দখলবাজ। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বে গত ৩৪ বছরে রূপগঞ্জে সংঘটিত বেশিরভাগ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সমন্বয়ক, পরিকল্পনাকারী, অর্থ যোগানদাতা ও নির্দেশদাতা তিনি। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার আলোচিত রাসেল ভূঁইয়া ও মোহাম্মদ আলী হত্যার নেপথ্যের খলনায়ক হিসেবে বারবার তাঁর নাম উঠে এসেছে। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে আইনের অধরায় তিনি। এছাড়া রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহরে ঠিকাদারি ও আবাসন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। যাঁর মাস্টারমাইন্ড নুরুজ্জামান খাঁন। টানা একমাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাঁর এইসব কুকীর্তি।
…..
দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলেও একটুও ভাটা পড়েনি নুরুজ্জামান খাঁনের ক্ষমতায়। কারণ খোলস পাল্টাতে সময় লাগে না তাঁর। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগ; সব দলের সাথেই আছে তাঁর বিশেষ যোগসূত্র। যে দলই সরকার গঠন করুক না কেনো, তাঁর রূপ পরিবর্তনের সময় লাগে না। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে পুরো রূপগঞ্জে অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে হয়েছেন ধনকুবের।
…..
নুরুজ্জামান খাঁনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ সত্ত্বেও কিছুতেই আইনের আওতায় আসছেন না তিনি। সরেজমিন অনুসন্ধানে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ পাওয়ার মতো বের হয়ে এসেছে তাঁর অপকর্মের ভয়ঙ্কর ফিরিস্তি। রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পূর্বগ্রামে জোর করে এবং নামমাত্র মুল্যে কিনে জমি দখলের অভিযোগের সূত্র ধরে বের হয় থলের বেড়াল। পর্দা খুলে যায় তাঁর অন্ধকার জগতের। নুরুজ্জামান খাঁনের নামে আতঙ্ক রূপগঞ্জের প্রতিটি ঘরে আর জনমনে। তিনি আপাদমস্তক একজন বিএনপির সক্রিয় রাজনীতিক হলেও তাঁকে বলা হয় সর্বদলীয় রাজনীতির সহচর। গত ২০০৯ সাল থেকে একটানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এসে অপরাধের সাম্রাজ্যে তাঁর উত্থান ঘটান। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট সিনিয়র দুই নেতা ওবায়দুল কাদের ও মাহবুবুল আলম হানিফের সাথে ছিলো তাঁর দহরম-মহরম। আর স্থানীয়ভাবে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অপকর্মের সহযোগী। রাজনৈতিক পরিচিতির সাথে বাড়তে থাকে তাঁর অপরাধের পরিধিও। এহেন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি তিনি। খুন-গুম, ভূমিদস্যুতা, বালু সন্ত্রাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নুরুজ্জামান খাঁনের হাতে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজীর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। এরপরই স্থানীয়দের জায়গা-জমি দখল, বালু সন্ত্রাস, পার্ক-হাট-বাজার, পরিবহন সেক্টর, শিল্প-কারখানা, আবাসন কোম্পানি নিয়ন্ত্রণসহ চাঁদাবাজি, ফিটিংবাজি, জুলুমবাজি, প্রতারণা-জালিয়াতি ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে অঢেল বিত্তশালী হয়েছেন। সরকারি সম্পত্তি কব্জা করার মাধ্যমে গড়ে তুলেন টাকার পাহাড়। সন্ত্রাসের মাধ্যমে তৈরি করেন ত্রাস। পুলিশের হাতে সদ্য গ্রেফতারকৃত গোলাম দস্তগীর গাজীকে হাত করে ও বিভিন্নভাবে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে জনস্বার্থ হানিকর যাবতীয় কাজ করেছেন এই কুখ্যাত ভূমিদস্যু মাফিয়া নুরুজ্জামান খাঁন। সরকারি কোনো ক্ষমতাধর বা জনপ্রতিনিধি না হয়েও দাপিয়ে বেড়ান পুরো রূপগঞ্জে। আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে অবজ্ঞা করা তাঁর কাছে মামুলি বিষয়! নুরুজ্জামান খাঁনের ক্ষমতার উৎস কী? প্রধানত রাজনৈতিক দলের সমর্থন। একশ্রেণীর অসাধু ও সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদদের সমর্থনে পাহাড়সম অপকর্ম করেছেন তিনি। নুরুজ্জামান খাঁনের দ্বারা দেশের ও জনগণের আদৌ কোনো লাভ হয় না। বরং দেশ, সমাজ, রাজনীতি ও দলের ইমেজকে কলুষিত করার জন্য তাঁর মতো মাফিয়া সাম্রাজ্যের গডফাদার যথেষ্ট। নুরুজ্জামান খাঁনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের অন্ত নেই। ধারাবাহিক নাটকের মতো একে-একে বের হচ্ছে তাঁর অজানা ও চাঞ্চল্যকর অপকর্মের বহু কাহিনী। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, নুরুজ্জামান খাঁনের ভূমিদস্যুতা, বালু সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, টর্চার ক্যাম্পসহ বিভিন্ন বেআইনি অবৈধ বিষয়। যে রাজনীতিকে অপব্যবহার করে মাফিয়া সাম্রাজ্যের গডফাদার হয়েছেন তিনি, রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে তাঁকে কঠোরভাবে দমন করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা। রাজনীতি জনগণের স্বার্থের জন্য, মাফিয়া বা গডফাদারদের অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ার জন্য নয়। রাজনীতিতে ত্যাগী নেতাকর্মী ও জনগণের গৌরবোজ্জ্বল অবদানে যে জনমুখী রাজনীতি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক, মাফিয়া সাম্রাজ্যের এই গডফাদার নুরুজ্জামান খাঁন তাতে কলঙ্কলেপন করেছেন। দ্রুত শুদ্ধি অভিযান এবং কঠোরভাবে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে রূপগঞ্জের মুক্ত সমাজ এবং বিশুদ্ধ রাজনীতিকে এই কুৎসিত মাফিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট ও ঠান্ডা মাথার খুনী- ভূমিখেকো দানব; নুরুজ্জামান খাঁনের রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা করা এখন এলাকার মানুষসহ বাস্তবতার দাবি।