নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জোড় যার মুল্লুক তার, নারায়ণগঞ্জে চলছে খাল দখলের রামরাজত্ব ! এমনটাই প্রমাণ করেছে নারায়ণগঞ্জের খাল দখলদারদের অনেকেই। একদিকে আইনশৃংখলা বাহিনী অপরদিকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে খাল দখল চলছে দীর্ঘদিন যাবৎ। নারায়ণগঞ্জে একেকজন কর্মকর্তা পোষ্টিং পেতে প্রতিযোগিতার পর কোটি টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আর এই ঘুষের কারণেই আইন আর আইনের ধারায় চলে না। ঘুষের টাকায় পোষ্টিং পেয়ে নারায়ণগঞ্জে এসেই যেন সেই সরকারী চাকরীকে ব্যবসায় পরিণত করেই চালায় ঘুষের রাম রাজত্ব। জানা যায়, একজন পুলিশের কন্সষ্টেবল এখনো নারায়ণগঞ্জে পোষ্টিং পেতে শীর্ষ একজন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। যা বিগত সরকারের শাসনামলে তালিকা ডিআইজির দপ্তরের টাঙ্গানো থাকত। বর্তমানে সেই তালিকা টাঙ্গানো না থাকলেও অলিখিত ঐ টাকা ঘুষ দিয়ে পোষ্টিং নিতে হয়। এর পরের ধাপ তো পাড়ি দিয়েই পছন্দমতো থানা বা ফাঁড়িতে যেতে আরো খরচা করতে হয় ৪০ হাজার টাকা।
এটি পুলিশের একজন কন্সষ্টেবলের ঘুষের তথ্য প্রকাশ হলেও ডিসি অফিস, ভূমি অফিস, পরিবেশ কার্যালয়সহ সকল সরকারী দপ্তরে যেন চলছে বেলকির কারবার। আর এই সরকারী দপ্তরগুলোতে টাকা দিয়ে কি না করা যায়? নারায়ণগঞ্জের এমন কোন দপ্তর আছে যে, দপ্তরে কোন ঘুষ লেনদেন হয়না? এমন কোন থানা আছে যে থানার ওসির নামে কোন ক্যাশিয়ার নাই? এমন কোন ভূমি কার্যালয় আছে যে কার্যালয়ে ভূমি দখলের মতো অনৈতিক ঘৃন্য কর্মকান্ড ঘটে না ? এমন মন্তব্য সর্বত্র আলোচনা সমালোচনায় উঠে আসলেও কোন সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী নৈতিকতা বা পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে না।
উদহারণ হিসেবে নারায়নগঞ্জের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “রূপসীর সিটি মিল যে খালটি দখল করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে তার নেপথ্যে কারা কাজ করেছে তার হিসাব কি কেউ নিয়েছে ? রূপসী স্লুইচ গেইট থাকলেও খাল কিন্তু এখন আর নাই! কোতায় সেই খালটি? একদিকে সরকারী কর্মকর্তা অপরদিকে প্রভাবশালী চক্র এই খাল দখল করে এখন বিশাল কারখানা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ সহ সকল আইনশৃংখলা বাহিনী কি করে?” যার কারণে নারায়ণগঞ্জের মতো এই জেলায় শিল্পায়নের নামে দখল হয়ে গেছে ৬৭ টি খাল।
প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণঞ্জ। প্রাচ্যের ডান্ডি হওয়ার পেছনে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশই প্রধান কারণ। খাল-নদের কারণে বাণিজ্যের বসতি গড়ে ওঠে এই নারায়ণগঞ্জে। খালগুলো দিয়ে অনায়াসে মালামাল আনা-নেওয়া করা যেত। কালের বিবর্তনে নারায়ণগঞ্জের সব উপজেলার খালগুলো নানা কারণে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক খালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে উধাও। বেশ কিছু খাল দখলদাররা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। দু’চারটা যা আছে তা-ও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। পরিবেশ ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান খাল উদ্ধারে মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিলেও নারায়ণগঞ্জের খালগুলো উদ্ধারে কোন গতি নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রয়েছে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে কিন্তু হচ্ছে না কোন কাজ। এখনও পর্যন্ত খাল উদ্ধারে বড় সাফল্য দেখাতে পারেনি তারা। উপজেলাগুলোর তথ্যমতে, জেলার রূপগঞ্জেই রয়েছে ৩১টি খাল। আড়াইহাজারা উপজেলায় ২২টি, সোনারগাঁয়ে ১৩টি, বন্দরে ৯টি, সিদ্ধিরগঞ্জে ৬টি, ফতুল্লায় ৭টি ও শহরে ৩টি খাল রয়েছে। আগে বেশিরভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটেরও বেশি। এগুলো বৃষ্টির পানি ধারণ ও নিষ্কাশনে ব্যবহার হত কিন্তু সেগুলি এখন উধাও!
স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ যুগের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জের খাল বিলুপ্ত হয়েছে। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ভূমি অফিসের কাছে দখলকারীদের কোনো তালিকা নেই। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো কিছু উচ্ছেদ অভিযান করলেও নেই কোণ বড়ধরনের জরিমানা। তবে তদারকির অভাবে উচ্ছেদের কয়েক মাস পরেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এসব খাল। পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছে,“কিছু মানুষ মুনাফার চিন্তায় খালগুলো ভরাট করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে। বিদ্যমান খালের অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে। কালের পরিক্রমায় খালের অস্তিত্ব শুধু বিলুপ্তিই হয়নি, সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল দালানকোঠা। খালের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাস্তা তৈরি করে ধ্বংস করা হয়েছে। বেশ কিছু খাল কাগজকলমে থাকলেও এগুলোর চিহ্নও নেই। এক সময় নারায়ণগঞ্জে ৯১টি খাল সচল ছিল। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ঐ খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলতো সেসব নদীখালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন নারায়ণগঞ্জ। প্রবাহমান নদী ও খালের সুবিধাই মুঘলদের বন্দর প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ রক্ষাসহ রণকৌশল করপোরেশন গড়ে তোলা হয় খালগুলোকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে দখলদারদের কারনে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৬৭টি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৯১টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি খালগুলো উদ্ধারে কোনো অভিযান হয়নি, আর হলেও নামে মাত্র লোক দেখানো বলে মন্তব্য জন-সাধারনের। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ঐ প্রতিবেদনে। নদী কমিশনেরও একই প্রশ্ন-এত খাল হারাল কোথায়? ৩০-৩২ বছর আগেও রূপগঞ্জের প্রান্তসীমায় স্রোতবাহী যেসব খালে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকার আনাগোনা ছিল, সে খালগুলো এখন দুই-আড়াই ফুট চওড়া ড্রেনের আকার ধারণ করেছে। এমনকি সরকারি ঐ দপ্তরে বহু খোঁজাখুঁজি করেও খালগুলোর নথি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই প্রভাবশালী মহল বছরের পর বছর ধরে খাল দখলের রাজত্ব চালিয়ে আসছে। আভিযানিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উচ্ছেদের পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভারী করার দিকেই বেশি উৎসাহী থাকে। প্রভাবশালী দখলবাজদের সঙ্গে গোপন লেনদেন সম্পন্ন হলে মাঝপথেই আটকে যায় উচ্ছেদের অভিযান। ফলে তাদের কব্জা থেকে খালগুলো মুক্ত করাও আর সম্ভব হয় না।
নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁ উপজেলার ঐতিহাসিক পঙ্খিরাজ খালটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে খালটি এখন সরু নালায় রূপ নিয়েছে। এক সময় খালটি পুরো সোনারগাঁ পৌরসভার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ ছিল। বর্তমানে খালটির বিভিন্ন স্থানে ভরাট ও দখলের কারণে খালটিতে পানি প্রবাহ নেই বললেই চলে। সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদীর শাখা মেনিখালীর সঙ্গে এ খালের সরাসরি সংযোগ ছিল। খালটি উদ্ধবগঞ্জ এলাকার ভট্টপুর দিয়ে ঐতিহাসিক পানাম নগরে প্রবেশ করেছে। এক সময় এ খাল দিয়েই দেশী-বিদেশী বণিকরা পানাম নগরে যাতায়াত করত।
এ ব্যাপারে, ভট্টপুর গ্রামের একজন বলে, ‘এ খাল দিয়ে আমাদের ব্যবসায়িক মালামাল আনা নেয়া করতাম। নৌকায় মানুষ পারাপার হতো এ খালটি দিয়ে। প্রভাবশালীরা খালটি প্রায় দখল করে নিয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে ময়লা ফেলে ভরাট করছে।’ এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা বলে, ‘পঙ্খিরাজ খালটি অনেক পুরনো, খালটিকে ঘিরে অনেক ইতিহাস রয়েছে। খালটি পুনরুদ্ধারের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি এবং মানববন্ধন করেছি। কিন্তু প্রশাসন খালটি উদ্ধারে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আমরা হতাশ।’
সোনারগাঁও উপজেলার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী আরেকটি বেহাকৈর খাল। উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রাম থেকে শুরু হয়ে সাদিপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খালটি বিস্তৃত। খালটির প্রায় পুরোটাই দখল হয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রশাসন বলছেঃ
রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারিকুল আলম বলে, ‘খাল দখলের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তালিকা তৈরি করে অভিযান পরিচালনা করব।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম বলে, ‘আমরা শীঘ্রই অভিযানে নামব।’
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাশেদ মাহমুদ বলে, ‘দূষণ রোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। খাল উদ্ধারের দায়িত্ব তো আমাদের নেই।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলে, ‘খাল দখলের অনেক অভিযোগ আছে। ইতোমধ্যে বন্দরের একটি খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শহর ও উপজেলার খালগুলো অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করা হবে।’
সোনারগাঁ নির্বাহী কর্মকর্তাকে কল করলে ইউএনও কল ধরে নাই। মেনি খালি দোষনমুক্ত ও আমান গ্রুপের হাত থেকে সরকারী রাস্ত দখল মুক্ত করার জন্য স্মারক লিপি দিয়েও ফারজানা ইসলাম কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে জানায় ভুক্তভোগিরা।