আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস: দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণ নেমেছে অর্ধেকে

267

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ করোনা (কোভিড-১৯) মহামারী শুরুর পর স্বাস্থ্যসেবায় ধস নেমেছে। এর প্রভাবে এরই মধ্যে দেশে স্বল্পমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ কমে গেছে ২৫ শতাংশ। আর দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণ নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে। এ সময়ে নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মহামারী কোভিড-১৯-কে প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’। দিবসটি উপলক্ষে জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক বক্তৃতা, র‌্যালি, অনলাইন সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি চলমান থাকলে এবং লকডাউন পরিস্থিতি যদি আরও ছয় মাস দীর্ঘ হয় তাহলে নিম্ন-মধ্যম ও নিম্ন আয়ের ১১৪ দেশে ৪৭ মিলিয়ন (৪ কোটি ৭০ লাখ) নারী আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি থেকে বঞ্চিত হবেন। আর অতিরিক্ত ৭ মিলিয়ন (৭০ লাখ) নারী অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের শিকার হবেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বাল্যবিবাহের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বিশ্বে ১৩ মিলিয়ন (১ কোটি ৩০ লাখ) বাল্যবিবাহ হবে। এর মধ্যে ৮ মিলিয়ন (৮০ লাখ) বাল্যবিবাহ হবে শুধু বাংলাদেশে। যেখানে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।

জানতে চাইলে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ হেলথ সিস্টেম স্পেশালিস্ট ড. দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, লকডাউন পরিস্থিতি ও মায়েদের মধ্যে করোনাভীতির কারণে ফ্যামিলি সার্ভিস সিস্টেম ব্যাহত হচ্ছে। তাদের পারসেপশন (চিন্তাভাবনা) ও ট্রাভেল করতে না পারা একটি বড় কারণ। এ ছাড়া সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অসুবিধা রয়েছে। যেমন: ডাক্তারা বলছেন, তারা যদি মানসম্মত পিপিই না পান তাহলে তারা সার্ভিস দেবেন কীভাবে। কারণ, কে কোভিড-১৯ পজিটিভ, আর কে নেগেটিভ-তা নির্ধারণ করা কঠিন। ধরেই নিতে হয় যে, সবার কোভিড-১৯ পজিটিভ। এমনভাবেই সচেতনতার সঙ্গে সেবা দিতে হয়।

ইমদাদুল হক আরও বলেন, সরকারের হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেমের ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারি হেলথ কর্মকর্তারা যে সেবাটি দিতেন তা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অধিকাংশ বাড়িতেই সবাইকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না (আবার কোথাও কর্মীরাও যাচ্ছেন না)। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় চলতি বছরের এ সময়ে স্বল্পমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা সিস্টেম ২৫ শতাংশ কমে গেছে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি। দেশে পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতিগত কোনো স্বল্পতা নেই। কিন্তু সার্ভিস প্রোভাইডররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিতে না পারায়, কোনো ক্ষেত্রে না যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ইমদাদুল হক বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। কমিউনিটি লেভেলে সচেতনতা তৈরি করে তাদের সার্ভিস নেয়ার জন্য বলতে হবে। আরেকটি হল মাস্ক ব্যবহার করে সার্ভিস সেন্টারে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া ইউএনএফপির সহযোগিতায় একটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এর কাজ হল এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারকে দিকনির্দেশনা দেয়া।

ইউএনএফপিএ-র বার্ষিক বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৯-এ বলা হয়েছে, ৫০ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১০ কোটি ৪৭ লাখ। বছরে ১ দশমিক ১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ। মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর।

এতে আরও বলা হয়েছে, দেশে ৫০ শতাংশ মা প্রসবের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পান না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশি। চাহিদা থাকার পরও ১১ শতাংশ নারী প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পান না।

জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ইউনিট) সেলিনা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে পরিবার পরিকল্পনার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, এ ক্ষেত্রে কিছুটা সার্জিক্যাল বিষয় আছে। আর অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ক্লিনিকগুলোয় আসতে চান না। তবে আমাদের ক্লিনিকগুলো খোলা রয়েছে। যারা সেখানে আসছেন, তারা সেবা পাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা নরমাল পদ্ধতিকে রেগুলার করতে পারলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি রেগুলার করতে পারছি না। এ ছাড়া আমাদের অধিদফতরের যত কর্মী রয়েছেন, সে অনুসারে সুরক্ষাসামগ্রীরও অপর্যাপ্ততা রয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ১৬ এবং মাতৃমৃত্যু হার ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে বর্তমানে ৭৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

সূত্র জানায়, দেশে এখনও অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকে কন্যাশিশুর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এমনকি বিয়ের পর সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। এসবের কারণে একদিকে বাল্যবিবাহ, সন্তান নেয়া, মাতৃমৃত্যু, নবজাতকের মৃত্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে এটি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

৫২ বছর আগে মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিবার পরিকল্পনাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্মারক ২৫৪২(১৯) ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়, বাবা-মা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে সন্তান নেয়া এবং বিরতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ১৯৯৪ সালে কায়রোয় অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের ধারা ৮-এ বলা হয়, সন্তান সংখ্যা, দুই সন্তানের মাঝে বিরতি দেয়ার বিষয়টি ব্যক্তির অধিকার।