দুর্নীতি ও অনিয়মের অপর নাম জ্যাকব

95

স্টাফ রিপোর্টার : চরফ্যাসন ও মনপুরায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন ভোলা-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। আপৎকালীন বরাদ্দ আত্মসাৎ, ইটভাটার চুল্লীতে বনবিভাগের গাছ ব্যবহার, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর), গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা-কাবিখা), দুঃস্থদের খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ) কর্মসূচীর বরাদ্দ আত্মসাৎ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সভা-সমাবেশে হামলা-সবকিছুতেই আছেন জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যরা।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি জ্যাকব টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য। আগের মেয়াদে বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া বাবদ ৭২ হাজার টাকা আয় দেখান তিনি। নগদ টাকার পরিমাণ দেখানো হয় ১২ লাখ ৩ হাজার ২৮৫ টাকা। অথচ সেই জ্যাকবই এখন নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। নানা সুত্রে উঠে এসেছে।
শুরুতে শুধু আমদানি, রফতানি, অ্যামব্রয়ডারি ব্যবসা ছিল জ্যাকবের। সংসদ সদস্য হওয়া পর ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। আয়কর নথির তথ্য অনুযায়ি, স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ৪৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৪ টাকার এবং তালিকভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে (মধুমতি ব্যাংক) ১২ কোটি টাকার শেয়ার আছে জ্যাকবের। তবে প্রদর্শিত আয়ের চেয়ে অপ্রদর্শিত আয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে অভিযোগ আছে।
জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ পাউবো, এলজিইডি, বিদ্যুৎ বিভাগে ঠিকাদারি এবং কৃষি খামারসহ নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন। জ্যাকবের হয়ে সবকিছুর দেখভাল তিনিই করেন। ১৯৯৭ সালে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের গণবীমা প্রকল্পে যোগ দেন সৌরভ। শুরুতে বেতন ছিল ১ হাজার ৭৫০ টাকা। জ্যাকব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত গণবীমা প্রকল্পেই ছিলেন। চাকরি ছাড়ার আগে তার বেতন হয় সাড়ে ৮ হাজার টাকা। সৌরভ এখন অনেক কিছুর পাশাপাশি বিকাশ এজেন্ট, ৬টি ইটাভাটার মালিক, হুন্ডি ব্যবসায়ী।
জ্যাকবের আরেক ভাই ইফতেখারুল ইসলাম বাবু কানাডার অন্টারিওতে বসবাস করেন। ৭৭ ইনভারনেস এভিনিউ নেপেন, অন্টারিও, কানাডা কেটুই সিক্সপিওয়ান তার ঠিকানা। ফ্ল্যাট নম্বর-২১২। জ্যাকবের স্ত্রী নীলিমা নিগার সুলতানা গৃহিনী থেকে এখন ব্যবসায়ী। অভিযোগ আছে জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ আয়ের টাকা কানাডায় ইফতেখারুল ইসলাম বাবুর হেফাজতে আছে।
১৮ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক জ্যাকব ও তার পরিবার :
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনোয়ারা ট্রেডার্স, ইউনুছ আল মামুন, বকশী এন্টারপ্রাইজ, মিলন ট্রেডার্স, জসিম কনস্ট্রাকশন, হাওলাদার টেডার্স, উপকূল কনস্ট্রাকশন, মা ট্রেডার্স, গ্রামীন এন্টারপ্রাইজ, উপকূল ব্রিকস, কাইফ এন্টারপ্রাইজ, অটিবিএল, বিজেগ্রুপ, ওয়েস্টিন ইন্জিনিয়ারিং, ডন কর্পোরেশন, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স, আরাধনা এন্টারপ্রাইজ, খন্দকার কন্সট্রাকশন-এই ১৮ প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে চরফ্যাসন ও মনপুরার ঠিকাদারি। নেপথ্যে আছেন জ্যাকব, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।
জ্যাকবের দুর্নীতির খন্ড চিত্র :
২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চরফ্যাশন ও মনপুরা শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন হয়। প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৪২ কোটি ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বাস্তবায়নকাল ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর তিন দফায় প্রকল্পটি সংশোধন হয়। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ১৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পে প্যাকেজ ছিল ২৯টি। এর মধ্যে ১৫টি ছিল ব্লক তৈরি ও ডাম্পিংয়ের কাজ। নদী ভাঙন ঠেকাতে দরপত্রে উন্নতমানের ব্লক তৈরির শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদাররা শর্ত ভঙ্গ করে নিম্নমানের ব্লক তৈরি করে। ব্লক নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিল ডন কর্পোরেশন, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, আরাধনা এন্টারপ্রাইজ ও খন্দকার কন্সট্রাকশন। প্রমাণ থাকার পরও নিম্নমানের ব্লকের বিল পরিশোধ হয়। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, টাস্কফোর্স এবং বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডি‘র প্রতিবেদনে প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির তথ্য উল্লেখ আছে। মন্ত্রণালয় ও টাস্কফোর্সে সে সময় কর্মরত ছিলেন এমন দু’জন কর্মকর্তা জানান, পাউবো’র কর্মকর্তারা জ্যাকবের নির্দেশে ঠিকানাদারদের বিল পরিশোধ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরফ্যাসন ও মনপুরায় মেঘনার ভাঙন রোধে চরফ্যাশন ও মনপুরায় ১ হাজার ৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকার কাজ চলছে। এর মধ্যে মনপুরায় ১ হাজার ১৫ কোটি ৭০ লাখ ও চরফ্যাসনের মুজিবনগর ইউনিয়নের ভাঙন রোধে ৭৭ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয় গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি। বন্যা, জোয়ার ভাটা, বর্ষাকালে প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের আঘাতের ক্ষয়ক্ষতি হতে জনসাধারণের জানমাল রক্ষা এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ভাঙ্গনরোধ, নদী ড্রেজিং, সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূর করা ও ভূমি পূনঃউদ্ধার এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রকল্পের ২৫টি প্যাকেজ কাজের মধ্যে ১২টি প্যাকেজের টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। বাকী কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় একক আধিপত্য জ্যাকবের। সহযোগিতায় আছেন জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ, ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের সব জেলায় ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে ঠিকাদার রেজিস্ট্রেশন, টেন্ডার আহ্বান, দাখিল, টেন্ডার খোলা, তার মূল্যায়ন, অনুমোদন এবং কার্যাদেশ দেওয়াসহ টেন্ডার সংক্রান্ত সবরকম কাজ হচ্ছে। শুধু চরফ্যাসন ও মনপুরায় ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি মানা হচ্ছে না।
অবৈধ বালু উত্তোলনেও জ্যাকব সিন্ডিকেট :
চরফ্যাশন-মনপুরার সবকিছুরই নিয়ন্ত্রণ জ্যাকবের হাতে। মেঘনা নদীর ১৫টি পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করছেন তাঁরই লোকজন। ১২টি ড্রেজার দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। নদীর বুকে নেমেছে ২০টি বাল্কহেড। আয়তন অনুযায়ী একেকটি বাল্কহেডে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনফুট বালুর ধারণক্ষমতা। বেতুয়াসহ চরফ্যাশন উপজেলার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বিভিন্ন পয়েন্টে বালু বিক্রি হচ্ছে। জ্যাকবের লোক হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, আকতার হোসেন, নাসির, নোমান, মনির ও বেলালের তদারকিতে চলছে বালু উত্তোলন। ঘনফুট দরে বালু বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আড়াই থেকে ৩ টাকা ফুট হিসেবে বালু কিনে বেশি লাভে বিক্রি করছে।
খাস মহল মসজিদ মিনার টাওয়ারের নাম পরিবর্তন :
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি চরফ্যাসনে খাস মহল মসজিদ মিনার টাওয়ার প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন সৌদি আরবের মক্কা শরীফের আল্লামা শায়েখ আবদুল হাফিজ মক্কী। সৌদি আরব সরকার ও জলবাবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে হয় প্রকল্পটি। ২০১৫ সালে প্রকল্পের শেষ হওয়ার কথা ছিল। কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর। টাওয়ারটির নির্মাণকালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন জ্যাকব। নির্মাণ করতে ২০ কোটি টাকা খরচ হয়। এর উচ্চতা ২২৫ ফুট। এক একর জমি উপর টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চরফ্যাশন পৌরসভা। প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল আর্কিটেক্ট ফোরাম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে ইউনুছ-আল মামুন জয়েন্ট ভেঞ্চার সরকার স্টিল। দু’টি প্রতিষ্ঠানই জ্যাকবের ঘণিষ্ট। নির্মাণ শেষে ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকল্পটির উদ্বোধন হয়। খাস মহল মসজিদ মিনার টাওয়ারের নাম হয়ে যায় জ্যাকব টাওয়ার।
ঠিকাদারদের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়েছেন জ্যাকব :
জ্যাকবকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ভয়ভীতিও দেখান তিনি। প্রতিবাদে ঠিকাদাররা আন্দোলনেও নেমেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চরফ্যাশন ও মনপুরার জন্য এলজিইডি’র ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজের কার্যাদেশ পায় একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার পরও কাজ শুরু করা যাচ্ছিল না। পরে ঠিকাদাররা আন্দোলনে নামেন।
জানা যায়, এলজিইডি’র ঠিকাদারি করতে ২০ শতাংশ কমিশন দিয়ে ‘গ্রিনকার্ড’ নিতে বলেছিলেন জ্যাকব। এ নিয়ে ঠিকাদার কাওসার হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, জুলফিকার আহম্মেদ, সায়েম, ইলিয়াস, মিজানুর রহমান, ছোটন, জামাল সিকদার, আবুল কাসেম, গিয়াস উদ্দিন, আরিফ হোসেন রনি, আবিদুল আলম ও হোসাইন সাদীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য সব মিটে যায়। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক দু’জন ঠিকাদার জানান, ‘১৫ পার্সেন্টে দফারফা হয়। কমিশনের এই হার এখনও বহাল আছে।’
আপৎকালীন বার্ষিক বরাদ্দ আত্মসাৎ :
অনুসন্ধানে জানা যায়, পাউবো দুর্যোগকালে ব্যবহারের জন্য প্রত্যেক সংসদ সদস্যের বিপরীতে আপৎকালীন ৫ কোটি টাকা করে বার্ষিক বরাদ্দ দেয়। চরফ্যাসন-মনপুরায় এই টাকা দুর্যোগ কবলিত মানুষের কাজে আসেনি। বরাদ্দের পুরোটাই জ্যাকব, তার ভাই ও ভাতিজার পকেটে গেছে। ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।
পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে নিয়োগ বাণিজ্য :
গত তিন মেয়াদে জ্যাকব নিজের নামে ডিগ্রি কলেজ, প্রয়াত বাবার নামে দক্ষিণ আইচা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম কলেজ, মায়ের নামে বেগম রহিমা ইসলাম কলেজ, স্ত্রীর নামে নীলিমা জ্যাকব মহিলা কলেজসহ ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার বা এমপিওভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানে অযোগ্যদের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আছে। প্রায় ২০০ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শত্যে দু’জন শিক্ষক বলেন, আওয়ামীলীগ করি, জ্যাকবের নির্বাচনে কাজ করেছি, যোগ্যতাও আছে। তারপরও টাকার বিনিময়েই চাকরি পেয়েছি।
ইটভাটায় পুড়ছে ম্যানগ্রোভ বাগানের কাঠ :
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরফ্যাসন-মনপুরায় মোট ৪৪টি ইটভাটা আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ি ১৮টি ইটভাটার ছাড়পত্র আছে। উপকূল ব্রিকস ও মনপুরা ব্রিকসসহ ২৬টি ইটভাটার ছাড়পত্র নেই। জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে থাকা এই ইটভাটাগুলোতে পুড়ছে সরকারি বনের গাছ। প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে পোড়ানো হচ্ছে ৪০০ মন কাঠ। নাম প্রকাশ করার শর্তে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সংসদ সদস্য চান না বলেই অভিযান হচ্ছে না।’
জেনিক ফিসারিজ ও জেনিল এগ্রো ফার্ম :
চরফ্যাসনের চর কলমি ইউনিয়নে দুই ছেলে জেনিক ও জেনিলের নামে দু’টি খামার করেছেন জ্যাকব। জেনিক ফিসারিজ ও জেনিল এগ্রো ফার্ম নামে এই দু’টি খামার দেখভাল করেন চর কলমি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন। এছাড়া চর নাংলায় এক দাগেই জ্যাকবের আছে ২০০ একর জমি। এই জমি দেখভাল করেন চর কলমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাওসার মাষ্টার। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে এসব সম্পদের কিছুই ছিল জ্যাকবের। এসব বিষয়ে জানতে কামাল ও কাওসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জেলেদের ভিজিএফ চাল বরাদ্দ আত্মসাৎ :
চলতি বছরের গত ১৬ এপ্রিল চরফ্যাসনের চর মানিকা ইউপি মিলনায়তনের সামনে ভিজিএফ চাল নিতে যান জেলেরা। ওজন করা দেখা যায় নির্ধারিত ৪০ কেজির চেয়ে কম চাল দেওয়া হচ্ছে। কয়েকজন জেলে প্রতিবাদ করলে দক্ষিণ আইচা থানার চর মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান শফিউল্লাহ হাওলাদারের লোকজন হোসেন নামে এক জেলেকে মারধর করে। চাল মেপে পরীক্ষা করার জন্য তদারকি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের গায়ে হাত তোলেন ইউপি চেয়ারম্যান।
চরফ্যাসন ও মনপুরার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এমন আরও অনেক ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২ মাস ভোলার মেঘনা নদীর ইলিশা থেকে মনপুরার চর পিয়াল পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার এবং তেতুঁলিয়ার ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তমের ১০০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশসহ সব মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এ সময় মাছ শিকারে বিরত থাকা জেলেদের প্রনোদনা হিসেবে চাল বিতরণ করা হয়।
জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞার দুই মাস কষ্টে থাকতে হয়। বিকল্প কাজ যোগার করতেও ব্যর্থ হন তারা। প্রণোদনা হিসাবে জনপ্রতি দুই মাসে ৮০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে নিবন্ধিত জেলেদের সবাই পান না। যারা পান তাদেরও পরিমাণে কম দেওয়া হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ি, চরফ্যাসনের ১টি পৌরসভা, ২১ টি ইউনিয়ন ও মনপুরা ৫টি ইউনিয়নে ৩৩ হাজার নিবন্ধিত জেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জ্যাকবের কথায় উঠাবসা করেন।
যারাই বিরুদ্ধে গেছেন তারা আর কখনই জনপ্রতিনিধি হতে পারেননি বলে জানান, নুরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। বলেন, জ্যাকবের বেঈমানির কারণে নৌকা প্রতীক পেয়েও জিততে পারেননি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। বলেন, রাজধানীর ধানমন্ডিতে জ্যাকবের ৩টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। গুলশানে বাড়ি কিনেছেন। গাজীপুরে ১৫০ একর জমির উপর খামার বাড়ি ও নরসিংদীতে ১০০ একর জমির উপর মৎস্য খামার করেছেন।
জিন্নাগড় ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মনজুর বলেন, টিআর, কাবিটা-কাবিখা, ভিজিএফ কর্মসূচি-যাদের জন্য বরাদ্দ তাদের বেশিরভাগই বঞ্চিত হয়েছেন। যখন চেয়ারম্যান ছিলাম জ্যাকবের নির্দেশেই কাজ করেছি। ইউপি চেয়ারম্যান থাকার সময় এসব বলেন নি কেন জানতে চাইলে মনজুর বলেন, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তখন সাহস হয়নি। এখন বলছেন কেন জানতে চাইলে বলেন, সবাই সবকিছু জেনে গেছে। তাই বলছি।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলার অভিযোগ :
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি অবসরে যান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও অফিসার্স ক্লাব ঢাকার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন। চরফ্যাসন ও মনপুরার আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ধর্মীয়সহ নানা উৎসবে ‘উপহার’ বিতরণ ও সভা-সমাবেশ করছেন সাবেক এই আমলা। আর এসব করতে গিয়েই বাঁধা পাচ্ছেন তিনি। সবশেষ বাঁধার সম্মুখিন হন গত ২৪ এপ্রিল। এদিন চরফ্যাশনের চেয়ারম্যান বাজারে জনসংযোগ করতে যান মেজবাহ। এ সময় মটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে যায় একদল ছাত্র-যুবক। মেজবাহ’র সামনেই তার ১৫ সমর্থককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। দক্ষিন আইচা প্রেস ক্লাবের সভাপতি আদিত্য জাহিদ ও সাধারন সম্পাদক সেলিম রানাও হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা এ জ্যাকবের সমর্থনে শ্লোগানও দেয়। খবর পেয়ে চরফ্যাশন থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করে। মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘জ্যাকব আমাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করেন। হামলার ঘটনা পরিকল্পিত।’
দায়মুক্তি ও নতুন অভিযোগ :
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জ্যাকবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ জমা হয়। অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্যাকবকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে আরও দু’টি অভিযোগ জমা হয়েছে দুদকে। অভিযোগ যাচাই বাছাই পর্যায়ে আছে বলে এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, আয়কর নথি ও নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদের বাইরে জ্যাকবের বেনামি সম্পদ কোথায় আছে, কার কাছে আছে, বিদেশে পাচার হয়েছে কি-না তা খুঁজে বের করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সুত্র ফেসবুক